Post Editorial Ganashakti

দাঙ্গায় ব্যোমকেশ, মন্দায় চিন্তামণির প্রেম

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial Ganashakti

চন্দন দাস


ব্যোমকেশ বক্সির সঙ্গী অজিত কুমার বন্দ্যেপাধ্যায়। তিনি সাহিত্যিক। তাঁদের আলাপ হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। ১৯৬৮-তে উত্তর কলকাতার সেই বাসা ছেড়ে বক্সী দম্পতি চলে আসেন কেয়াতলায় — নিজস্ব বাড়িতে। অজিত তখনও তাঁদের সঙ্গেই আছেন। তাঁদের সংসারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রদোষ সি মিটার হলেন ফেলুদা। তাঁর সঙ্গী দু’জন। সেই দুইয়ের অন্যতম জটায়ু— লালমোহন গাঙ্গুলি। একের পর এক বেস্ট সেলার তাঁর নামের সঙ্গে জোড়া। তাঁদের আলাপ জয়পুরগামী ট্রেনে। 
সাম্প্রতিককালে আমরা বাংলায় আরও কয়েকজন গোয়েন্দার দেখা পেয়েছি। তবে মূলত চলচ্চিত্রে অথবা ওটিটি মাধ্যমের সিরিজে। শবর দাশগুপ্ত, দময়ন্তি, একেন বাবুরা এসেছেন। রহস্যের সমাধান হয়েছে। ষড়রিপুই কোনও না কোনও ভাবে যাবতীয় অপরাধের অ্যালিবাই হিসাবে ফের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 
কিন্তু সাম্প্রতিককালের কোনও গোয়েন্দাই সহকারী অথবা সঙ্গী হিসাবে সাহিত্যিকদের খুঁজে পাননি। অথবা বেছে নেননি। গোয়েন্দা গল্প আছে। যে ফর্মেই হোক। আছে। কিন্তু সাহিত্যিক নেই। গোয়েন্দার কীর্তি লিখে রাখার কোনও প্রত্যাশা সময়ের নেই।


সাহিত্যিক এতটা ব্রাত্য কেন? নাকি সাহিত্য?
ব্যোমকেশ লিখতে লিখতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও কখনও ঢুকে পড়েছেন দেশভাগ, স্বাধীনতা এবং দাঙ্গা প্রসঙ্গে। দাঙ্গাবাজ, সাম্প্রদায়িকতায় বিভ্রান্ত যুবককে বেআইনি অস্ত্র সরবরাহকারী হিসাবেও এঁকে ফেলেছেন। সাম্প্রদায়িকতায় বিভ্রান্ত যুবার চরিত্র তিনি এঁকে ফেলেছেন ‘রক্তের দাগ’-র মতো কয়েকটি উপন্যাসে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কসবাদী এমন দাবি করার লোক নেই। তিনি রাজনীতিতে উৎসাহী — এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কোনও উপাদান তাঁর লেখায় নেই। তবু তাঁর লেখায় ১৯৪৬-’৪৮-র বাস্তবতা আঁকা হয়েছে।
গল্প, উপন্যাস এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে কবিতা অনেক শক্তিশালী কিন্তু সহজে বাস্তব বিবরণের অস্ত্র।



সেই সূত্রে সেই দুপুরে হাজির হই সেই খিড়কির দরজার কাছে। তখন গৌরাঙ্গ মুখোমুখি হয়েছে চিন্তামণির। চিন্তামণির প্রতি দুর্বল হলেও অনেকদিন গৌরাঙ্গ তাঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। তিনি কৃষক। চিন্তামণি সমাজের বিচারে তার চেয়ে নিম্নবর্গীয়। কিন্তু মন্বন্তরে মৃত মানুষের সারি দেখে শিহরিত, মন্দায় বিধ্বস্ত, একাকিত্বে ক্লান্ত গৌরাঙ্গকে টেনে নিয়ে যায় চিন্তামণির কাছে। মানিক বন্দ্যাোপাধ্যায় উপন্যাসটি শেষ করছেন এইভাবে—‘‘এদিক ওদিক তাকিয়ে গৌর চিন্তামণির হাত চেপে ধরে, মিনতি করে বলে যে চিন্তামণি যদি তাকে ছেড়ে দেশে চলে যায় সেও তাহলে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে যাবে ঘর ছেড়ে নয়তো আত্মঘাতী হবে। আর সে এমন ব্যবহার করবে না চিন্তামণির সঙ্গে। চিন্তামণি মাপ করুক তাকে।’’ উপন্যাসের নায়ককে মহানায়ক, ইস্পাত দৃঢ় কোনও চরিত্রে অবতীর্ণ করানোর কোনও উদ্যোগই নেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট মন্বন্তরে সে বিধ্বস্ত এক পুরুষ। আর চিন্তামণি? ‘‘দুপুরবেলা খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে গৌরের কথা শুনতে শুনতে চিন্তামণির মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন মনে হলেও রোমাঞ্চ হয় চিন্তামণির। পঁইছের টাকায় কিছুদিন গেল। তারপর গেল জমিজমা ঘরদুয়ার বাসনপত্র। তারপর গেল পুঁটু ও গৌরের মা।’’ অর্থাৎ মন্বন্তরের প্রভাবে অভাব এমন জায়গায় পৌঁছালো যে গ্রামের কৃষক সর্বস্ব হারালো। হারালো আত্মীয়দেরও। নিষ্ঠুরতার বর্ণনার জন্য, মন্দা আর শাসকদের অর্থনীতির মারাত্মক প্রভাবের অন্তিম দশা বোঝানোর জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক একটি তরবারির মতো সহজ বাক্য ব্যবহার করলেন।




অতঃপর? শ্রেণিগত অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত এবং সাবলীল ভাষ্যে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন,‘‘চিন্তামণি বলল, এখানে থেকে কেন শুকিয়ে মরবে? তার চাইতে চলো বড়নিছিপুরে দিদির কাছে যাই। মস্ত কারখানা হয়েছে, তুমি কাজ করবে আমি কাজ করব, একরকম করে চালিয়ে নেব দু’জনে মিলে। সেথায় তো জানা চেনা কেউ নেই তোমার, একসাথে থাকতে ভয় পাবে না তুমি।’’ গৌরাঙ্গের জবাব কী হলো? ‘‘গৌর বলল, ভয়? কীসের ভয়? এখানেই একসাথে থাকছি এসো না আজ থেকে।’’ তীব্র মন্দা, অভাব আর শাসকের মানুষ মারা অর্থনীতি গ্রামবাসী গৌরাঙ্গকে কোনও চেতনায় পৌঁছে দিল? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায় গ্রামীণ গরিবের মানসিক অবস্থার বিবরণ,‘‘আজ গৌরের আত্মীয় নেই, জমিজমা নেই, পেটে ভাত নেই — কাকে তার ভয়, কীসের তার লজ্জা।’’ সর্বহারার কী আছে হারানোর? শৃঙ্খল ছাড়া?



১৯৪৬-এ প্রকাশিত এই উপন্যাসে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আর পরাধীন, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের গ্রামবাসী পরিবারগুলির দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে। এই নিয়ে বিশালাকার অনেক প্রবন্ধ আছে। আরও হতে পারে। তা দরকারিও। কিন্তু ওই একটি উপন্যাসের বলা কথায় জীবন, যন্ত্রণা, ভালোবাসা এবং তার আর্থিক ভিত্তি? স্পষ্ট।
আমরা করোনা পেরিয়ে এলাম। আমরা লকডাউন দেখলাম। আমরা তীব্র মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা কৃষকের আত্মহত্যার খবর নিয়মিত পড়েছি। ঋণের জালে জর্জরিত শহুরে মধ্যবিত্তর সপরিবারে আত্মঘাতী হওয়ার কাহিনির সঙ্গেও আমরা প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছি। আমরা গ্রামে গ্রামে কন্যা শ্রীর ব্যর্থতা আর নারী, শিশু পাচারের বেড়ে চলার পরিসংখ্যান ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তালিকায় দেখে ফেলছি। সুন্দরবন অথবা চা বলয়ে এমন ঘটনার নানা বিবরণ পাচ্ছি। ফেসবুকে পোস্ট হচ্ছে। ভিডিও-তে বিবরণীও চলছে। ব্যাখ্যা তো আসছেই। কিন্তু ‘চিন্তামণি’ জন্ম নিচ্ছে না।



প্রশ্ন হলো— কেন হচ্ছে না?
চলচ্চিত্রেও কি এল? বেশ কিছু বছর ধরেই সমাজের শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্র। সমাজের ছবি গল্প বলার ভঙ্গিমায় এই মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, এমন ব্যক্তিত্বের তালিকা এই রাজ্যে খুব সংক্ষিপ্ত নয়। একের পর এক চলচ্চিত্রের নাম লিখে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনদের সৃষ্টি সম্পর্কে বিস্তারিত বলারও কোনও মানে নেই। তবু সেই দৃশ্যটির কথা চলে আসে স্বতঃস্ফূর্ততায়— ঘরে শায়িতা দীর্ঘপথের সুখ দুঃখের শরিক মৃত স্ত্রী, আশপাশে পড়শিরা। ছেলে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পার্টি নির্দেশ ভেঙে মা’র মৃত্যুর খবর শুনে চলে এসেছে বাড়িতে। ছেলেকে দীর্ঘ অসাক্ষাতের পরে, স্ত্রীর জীবনাবসানের দিন কাছে দেখে প্রৌঢ় পিতা কী বলতে পারেন?



ভিড় থেকে ছেলেকে আলাদা করে দেওয়ালের কোণায় টেনে নিলেন বাবা। বললেন, ‘‘একটা কথা বলা হয়নি আগে। আমাদের কারখানায় মালিকপক্ষ ইউনিয়ন করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ইউনিয়ন করব না— এই মুচলেকা দিতে হচ্ছে। অনেকেই দিয়েছে। আমি দিইনি।’’ ঘরে অসুস্থ স্ত্রী। অভাবে দীর্ণ সংসার। মিছিল ছাড়া আর কোনও আশাই অবশিষ্ট নেই। ছেলে উপার্জন করে ‘পাশে দাঁড়াবে’ সন্তান, এমন কোনও ভরসা নেই। ছেলের রাজনীতির পথের যাত্রীও তিনি নন। সেই প্রৌঢ় তবু পলাতক ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রথম এই কথটিই বললেন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, মৃণাল সেন বলালেন। 
সেটাই সময়ের দাবি। অস্বাভাবিক, ভয়ঙ্কর সময়ের সেটিই অস্বাভাবিক রকমের অবধারিত কথোপকথন।


আর কিছু? আছে। পুলিশ খোঁজ পেয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে চলে আসতে পারে। ছেলেকে চলে যেতে বলা প্রৌঢ় শেষ কথা বললেন,‘‘বি ব্রেভ।’’
এই সবই বহু আলোচিত। এবং তা নিয়ে সমঝদাররাই আলোচনা করেছেন।
কিন্তু বেসিক প্রশ্ন— এক পদাতিকের আর এক পথ খুঁজে ফেরা মানুষকে ‘বি ব্রেভ’ বলার মতো দৃশ্যশ্রাব্য উপন্যাস, ছোট গল্প কেন আসছে না? সাহিত্য অথবা সিনেমায় রেড ভলান্টিয়াররা কী চরিত্র হয়ে উঠতে পারলেন? কেউ চেষ্টা করছেন না, তা নয়। অনেকে লিখছেন। কিছু পত্রিকায় ছাপাও হচ্ছে। কিন্তু তা আমাদের আলোচনার পরিমণ্ডলে যতটা প্রয়োজন, ততটা জায়গা করে নিতে পারছে না। আমরা কী খুঁজে নিচ্ছি সে সব লেখা? ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটের চারতলায়, ‘বুধবারের বৈঠকে’ প্রথমবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হারানের নাতজামাই’ পড়েছিলেন। মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে ‘কাঁপা কাঁপা নরম গলায়’ (চিন্মোহন সেহানবীশের বর্ণনায়) এক কিশোর প্রথমবার পড়েছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি।’ কিশোরের নাম? সুকান্ত ভট্টাচার্য। সাহিত্যের আলোচনা, তর্ক, পর্যালোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সেই ‘৪৬নং’। সেখানে গল্প পড়াও যেমন হতো, তেমনই গানও হতো। তরুণ সাহিত্যিকরা নিজেদের লেখা পড়ার সুযোগ পেতেন নতুন লেখা পড়ার আসরে।


১৯৪৩-র গোড়ার দিকে, অর্থাৎ প্রায় ৮০ বছর আগে ‘অরণি’র কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন এক কিশোর। সম্পাদক সত্যেন মজুমদার। কিশোরটি সত্যেন মজুমদারের সামনে এসে দাঁড়ালো। লাজুক স্বরে জানালো,‘‘আপনি আমায় আসতে লিখেছেন।’’ তাঁর হাত থেকে তাঁর নিজের লেখা চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে সম্পাদক প্রশ্ন করলেন,‘‘তুমিই সুকান্ত?’’ সে ঘাড় নাড়তেই তিনি আরও জানতে চাইলেন সে কী কী লেখে আরও। কবিতা লেখে শুনে বললেন,‘‘বেশ তো মাঝে মাঝে পাঠিও। তোমার এ লেখাটা আমরা ছাপাবো।’’ নমস্কার জানিয়ে বিনীত সেই কিশোর, ‘সুকান্ত’ দরজার দিকে ফিরতেই সত্যেনদা তাকে ডাকলেন আর ড্রয়ার থেকে ১০ টাকা হাতে দিয়ে বললেন,‘‘বেশ লিখেছ— তবে এর বেশি তো আমরা দিতে পারছি না।’’


কোনও পত্রিকায় লেখা প্রকাশ বাবদ অর্থ উপার্জন সেটিই ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্যর জীবনে প্রথম। 
আমরা কি ডেকে নিতে পারছি কোনও সম্ভাবনাকে? পড়ছি? বলতে পারছি —‘ভালো লিখেছ।’ এই সবই ছিল দীর্ণ সময়ের মোকাবিলায় বলিষ্ঠ, সংগঠিত উদ্যোগের উদাহরণ। ১৯৪২-এ শুরু। অনেকদিন আগে। তবে আজও কি প্রাসঙ্গিক নয়? সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়া ব্যক্তির সৃষ্টি সম্ভব নয়। তবে অতীতের গাঁথা বলে বর্তমান নিয়ে হা হুতাশ করার মধ্যে কোনও সার্থকতা নেই। আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে রাস্তা।

Comments :0

Login to leave a comment