প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অতি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির কর্পোরেট সাম্রাজ্যকে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য মোদী সরকার কতটা সক্রিয় ও বেপরোয়া তার আভাস মিলেছে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার মালিকানার সর্বশেষ চিত্র থেকে। আদানির সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক এবং সেই সুবাদে উল্কার গতিতে আদানি সাম্রাজ্যের বিস্তার নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের। রাজনীতিক হিসাবে মোদীর এবং শিল্পপতি হিসাবে আদানির উত্থান এবং শীর্ষারোহণ হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন রাজ্যের শিল্প-বাণিজ্যের শীর্ষে উঠে আসেন আদানি। পরে মোদী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন আদানি দেশের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পপতি। মোদীর সাহচর্যে মাত্র কয়েক বছরে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনকুবের হয়ে উঠেছিলেন আদানি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর বেশির ভাগ বিদেশ সফরের হয় সঙ্গী হতেন অথবা আগে পরে সফর সারতেন। দেখা গেছে কোনও দেশের সঙ্গে আদানিদের যখনই বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে তার আগে বা পরে সেই দেশের সঙ্গে মোদীর বৈঠক বা কথাবার্তা হয়েছে। তাই অনেকেরই অনুমান মোদীর কল্যাণে ভারতের কূটনৈতিক সুবিধাটাকে কাজে লাগিয়ে আদানিদের বিদেশে বাণিজ্য বিস্তার সহজ হয়েছে।
মোদীর সৌজন্যে আদানি সাম্রাজ্যের উত্থান ও বিস্তারের এই পর্বের ধারাবাহিকতার পাশাপাশি এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে গত দুই আড়াই বছরে। বিশেষ করোনা মহামারী পর্বে। যখন গোটা বিশ্বের মত ভারতের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত তখন ভোজবাজির মত আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার মূল্য বেড়েছে হু হু করে। তার ফলে আদানির সম্পদ এক ঝটকায় বহুগুণ বেড়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি। ভাবা যায় যখন দেশের লক্ষ লক্ষ সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, কয়েক কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ঘরে ঘরে অচলাবস্থা তখন আদানির মুনাফা বাড়ছে, সম্পদ বাডছে ঝড়ের বেগে।
মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট থেকে জানা যায় আদানির সম্পদ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির রহস্য। স্পষ্ট হয়ে যায় অবৈধ উপায়ে টাকা লেনদেন করে, জালিয়াতি ও কারচুপি করে কৃত্রিমভাবে শেয়ার মূল্য বাড়িয়ে আদানিরা সম্পদশালী হয়েছে। জালিয়াতি ফাঁস (২৪ জানুয়ারি, ২০২৩) হবার পরই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে আদানিদের ইমারত। শেয়ার মূল্যে ধস নেমে কিছুদিনের মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষ কোটি টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। প্রমাণ হয়ে যায় শক্তিশালী ভিত্তির উপর আদানি সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেনি। তাই সামান্য ধাক্কাতে ধসে গেছে।
তখনই জানা যায় আদানি সাম্রাজ্যের রসদ কীভাবে জুগিয়েছে মোদী সরকার। জালিয়াতি করে অস্বাভাবিক বেশি মূল্যের শেয়ার কেনানো হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এলআইসি-কে দিয়ে। এলআইসি লগ্নি করলে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। তখন অন্যরাও শেয়ার কিনতে নামে। তেমনি স্টেট ব্যাঙ্ক সহ সরকারি ব্যাঙ্কগুলিকেও বাধ্য করা হয় ঝুঁকি যাচাই না করেই বিপুল ঋণ দিতে। প্রশ্ন ওঠে মোদীই কি এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্ককে বাধ্য করেছেন বন্ধুর সংস্থায় যথেষ্ট টাকা ঢালতে? মোদী জবাব দেননি। উল্টে বিরোধীরা সরব হলে আদানির জালিয়াতিকে দেশের স্বার্থের বর্মের আড়ালে ঢাকার চেষ্টা করে নেতা-মন্ত্রীরা। মোদী জমানায় এটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয় যে আদানি গোষ্ঠীর কর্পোরেট স্বার্থ আর ভারতের জাতীয় স্বার্থ এক। বিরোধীরা দাবি তোলে আদানি কেলেঙ্কারির নিরপেক্ষ তদন্তের। জানতে চায় আদানিদের জালিয়াতির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক। তাই যৌথ সংসদীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে সব বিরোধীরা এক সুরে সোচ্চার হয়। তদন্ত এড়াতে মরীয়া হয়ে ওঠে সরকার।
এখন দেখা যাচ্ছে আদানি সাম্রাজ্যকে পতন থেকে রক্ষা করতে ফের মোদী সরকার অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার মূল্যে ধস নামার পরও এলআইসি-কে বাধ্য করেছে আদানি গোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব কেনার জন্য। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মজুত সঞ্চয় ব্যবহার করে এক সময় আদানিদের সম্পদ বাড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। এখন ধসে যাওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের ফের জনগণের সম্পদ ব্যবহার করা হচ্ছে এলআইসি’র মাধ্যমে।
Comments :0